বাগিচায় বুলবুলি তুই
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত বাংলা গজল।
‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’ একটি বাংলা গজল।[১][২] কাজী নজরুল ইসলাম বঙ্গাব্দ ১৩৩৩[৩] (১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ) সালে গজলটি রচনা ও সুরারোপ করেন, যা কে মল্লিকের কন্ঠে প্রথম ধারণ ও প্রকাশ করা হয়।[২] ১৯২৮ সালে দুর্গাপুজার সপ্তাহে কলকাতা হতে তৎকালীন হিজ মাস্টার্স ভয়েস রেকর্ড কোম্পানি এই সঙ্গীত বা গানটি প্রথম প্রকাশ করে।[২] একইবছর, কলকাতার ডি এম লাইব্রেরী হতে নজরুল গীতি সংকলন ‘বুলবুল’-এর প্রথম খণ্ডে গানটির গীত সংকলিত হয়।[৪] নজরুল এই গজলে বুলবুলি এবং তার প্রিয় একটি ফুলের মধ্যকার রূপক সম্পর্কের মাধ্যমে প্রেম এবং বিষাদ উভয়ই তুলে ধরেছেন।[১] বাংলা গজল হিসেবে গানটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিল্পী কর্তৃক পুনরায় গাওয়া হয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলাম ও তার পুত্র বুলবুল:
বুলবুলকে নিয়ে নজরুলের একটি বেদনাময় কাহিনী……..
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ২য় পুত্র ছিলেন বুলবুল। তিনিও ছিলেন অসামান্য মেধাবী। সবাই তাকে কবি নজরুলের যোগ্য উত্তরসূরি ভাবতেন। কবি তাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। ছোটকালে কবি নজরুল তার পুত্রকে একটি গজল শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বুলবুল সেই গজলটি কচি কণ্ঠে অত্যন্ত সুমধুর সুরে বলতেন। পুত্রের কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে যেতেন তিনি।
কিন্তু কবির এই পরম প্রিয় পুত্র মাত্র সাড়ে চার বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
এরপর থেকেই কবি শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হতে শুরু করেন।
যে মানুষটি বন্ধুদের আড্ডা মাতিয়ে রাখতো, সদা চঞ্চল সেই মানুষটি একদম বিমর্ষ হয়ে পরেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া পর্যন্ত তার বিমর্ষতা কাটে নি। এতটাই পুত্রশোকে বিহ্বল ছিলেন তিনি।
কবির পরম প্রিয় সেই পুত্র বুলবুল কে নিয়ে নজরুলের দুইটি খুবই বেদনাময় কাহিনি আছে তা হল-
চার বছরের শিশু বুলবুল যে রাতে মারা গিয়ে ছিল, সে রাতে তার পকেটে একটা কানাকড়িও ছিল না। অথচ কাফন,দাফন,গাড়িতে করে দেহ নেওয়া ও গোরস্থানে জমি কেনার জন্য দরকার ১৫০ টাকা, সে সময়ের ১৫০ টাকা মানে অনেক টাকা। এত টাকা কোথায় পাবে। বিভিন্ন লাইব্রেরীতে লোক পাঠানো হল। না, টাকার তেমন ব্যবস্থা হয়নি। শুধুমাত্র ডি. এম লাইব্রেরি দিয়েছিল ৩৫ টাকা। আরো অনেক টাকা বাকি। টাকা আবশ্যক। ঘরে দেহ রেখে কবি গেলেন এক প্রকাশকের কাছে। প্রকাশক শর্ত দিল। এই মুহূর্তে কবিতা লিখে দিতে হবে। তারপর টাকা।
কবি মনের নীরব কান্না,যতনা লিখে দিলেন কবিতায়…
“ঘুমিয়ে গেছে শান্ত হয়ে
আমার গানের বুলবুলি
করুন চোখে চেয়ে আছে
সাঁঝের ঝরা ফুলগুলি”
কবি এভাবে পুত্র শোকে তার কষ্টের দিন গুলো পার করতে লাগলেন, একদিন “পঞ্চানন ঘোষাল তখন কলকাতার তরুণ পুলিশ অফিসার। কাজী নজরুলকে তিনি ভালোবাসেন এবং মাঝে মাঝে তার সাথে গল্প করেন। একবার কবির বাসায় তল্লাশীর হুকুম এল উপর থেকে। এ বেচারাকে দায়িত্ব দেয়া হল সে দলে থাকার। গোয়েন্দারা তাকে নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল কবির ঘরের। কাজী নজরুল দরজা খুলে দিলেন এবং সঙ্গত কারণে এই তরুণ অফিসার এবং কবি দুজনই পরস্পরকে না চেনার ভান করে রইলেন। গোয়েন্দা পুলিশের দল কবির ঘরে সবকিছু তছনছ করে তল্লাশী চালাচ্ছে, কবিও তাদেরকে যথাসম্ভব বাক্স খুলে খূলে দেখাচ্ছেন।
হঠাৎ ঘরের কোনে পরম যত্ন উঠিয়ে রাখা একটি বাক্সে নজর পড়ল তাদের। তারা সেটি খুলে দেখতে চাইল। কবি অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন, না না, ওটাতে হাত দিবেন না যেন।
কবির বিচলিত মুখভঙ্গি দেখে পুলিশদের সন্দেহ তীব্র হল। তাদের একজন সজোরে সেটি খুলতেই সেই বাক্সটি থেকে ঝরে পড়ল কিছূ খেলনা আর ছোট ছোট জামা কাপড়সহ বাচ্চাদের অন্যান্য সামগ্রী।
এভাবে সেগুলো আছড়ে মাটিতে পড়তে দেখে কবির দু চোখ পানিতে ভরে গেল। ঝরঝর করে তিনি কেঁদে দিলেন সবার সামনে। এমন সুকঠিন মুখখানা তার ব্যাথায় ও দুঃখে কালো হয়ে এল।
এ খেলনা ও ব্যবহার্য সামগ্রীগুলো ছিল কবির আদরের সন্তান এই ছোট বুলবুলের। তার মৃত্যুর পর এসব বুকে জড়িয়ে কবি স্বান্ত্বণা খুঁজে পেতেন, আদর আর চুমো পৌঁছে দিতেন বুলবুলের গালে।
এ অফিসার তার এক লেখায় নিজেকে অত্যন্ত
ব্যর্থ ও লজ্জিত উল্লেখ করে লিখেছেন, এরপর কত মানুষের কত ঘর সার্চ করেছি,
কিন্তু সেদিনের মতো এমন কষ্ট আর কোথাও পাইনি।
বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে
কাজী নজরুল ইসলাম
বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে
দিসনে আজি দোল ।
আজো তার ফুলকলিদের ঘুম টুটেনি
তন্দ্রাতে বিলোল ।।
আজো হায় রিক্ত শাখায় উত্তরী বায়
ঝুরছে নিশিদিন
আসেনি দখনে হাওয়া গজল গাওয়া
মৌমাছি বিভোল ।।
কবে সে ফুল-কুমারী ঘোমটা চিরি
আসবে বাহিরে ,
শিশিরের স্পর্শসুখে ভাঙবে রে ঘুম
রাঙবে রে কপোল ।।
ফাগুনের মুকুল – জাগা দুকুল ভাঙ্গা
আসবে ফুলের বান ,
কুড়িদের ওষ্ঠপুটে লুটবে হাসি ,
ফুটবে গালে টোল ।।
কবি তুই গন্ধে ভুলে ডুবলি জ্বলে
কুল পেলিনে আর
ফুলে তোর বুক ভরেছিস আজকে জলে
ভরবে আখির কোল ।।
ভৈরবী-কাহারবা।