ইরান বনাম ইসরায়েল: কার ক্ষেপণাস্ত্র বেশি বিধ্বংসী

বিজ্ঞাপন

ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে টানা ৭ দিন ধরে সংঘাত চলছে। সবশেষ বুধবার ভোররাতে ইসরায়েলের ওপর দ্বিতীয় দফায় বড় ধরনের হামলা চালায় ইরান। এই হামলায় তারা ব্যবহার করে ফাত্তাহ-১ নামের হাইপারসনিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। এই ক্ষেপণাস্ত্রের কথা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই আন্তর্জাতিক মহলে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইরানের প্রায় দুই হাজারটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। মার্কিন ওয়ার ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, ইরানের সবচেয়ে বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেড সাধারণত ২,০০০–৪,০০০ পাউন্ড (৯০০-১,৮০০ কিলোগ্রাম) হাইড্রোকার্বন বিস্ফোরক ধারণ করে।

বিজ্ঞাপন
এর মধ্যেই সবচেয়ে বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে খোর্রমশাহর যা ৮–১৬ ম্যাক গতিতে উড়তে পারে (ম্যাক সমান শব্দের গতির সমান বা ঘণ্টায় ১,২০০ কি.মি) এবং এসব ২,০০০ কি.মি দূরে আঘাত হানতে পারে। এটি ১,৮০০ কেজি বিস্ফোরক বহন করতে পারে। এ ছাড়াও মধ্য পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে রয়েছে শাহাব‑৩, এমাদ, সেজ্জিল, যাদের রেঞ্জ ১,৩০০–১,৭০০ কি.মি এবং হালকা থেকে মাঝারি ওজনের কনভেনশনাল ওয়ারহেড থাকে। 

ইরানের অতি উচ্চগতির ক্ষেপণাস্ত্র ফাতাহ‑১ এ পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষমতা থাকলেও এতে এখনও নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ব্যবহার হয়নি।

বিজ্ঞাপন
এদিকে, আক্রমণের জন্য জেরিকো সিরিজের দূরপাল্লার আইসিবিএম জেরিকো-থ্রি ব্যবহার করেনি ইসরায়েল। যার পে-লোড বা বিস্ফোরক বহন ক্ষমতা ও রেঞ্জের সক্ষমতা প্রমাণ করে যে এসব ক্ষেপণাস্ত্রের পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু চলমান সংঘাতে এসব ব্যবহার করা হচ্ছে না। ইসরায়েল মূল লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে। অ্যারো-থ্রি, আয়রন ডোম, পেট্রিয়ট, থাড নামের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রায় ৯০–৯৫ শতাংশ ইরানের আক্রমণ প্রতিহত করা হচ্ছে।

কোন দেশের ক্ষেপণাস্ত্র বেশি বিধ্বংসী

ইরানের খোর্রমশাহর, ফাতাহ-১, সেজ্জিল-এর বিধ্বংসী ক্ষমতা ব্যাপক। প্রতিটিতে প্রায় দুই টন বিস্ফোরক থাকে। এগুলো একাধিক স্থাপনা ধ্বংস করতে সক্ষম। 

বিজ্ঞাপন

ইসরায়েল চলমান এ সংঘাতে পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনক্ষমতা সম্পন্ন জেরিকো-৩ ব্যবহার করেনি। তাই এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে ইরানই। 

বিজ্ঞাপন
এসব ক্ষেপণাস্ত্রে মূলত প্রচলিত হাই-এক্সপ্লোসিভ মাত্রার বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইরানের খোর্রমশাহর ও ফাতাহ ক্ষেপণাস্ত্রে এমনই বিস্ফোরক থাকে।

ইরান এখনও পারমাণবিক বোমা তৈরি করেনি, তবে দেশটির ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে, অর্থাৎ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে তেহরান। তবে বোমার জন্য প্রয়োজনীয় ওয়ারহেড তৈরি এবং তা ক্ষেপণাস্ত্রে যুক্ত করার কাজ এখনও অসম্পূর্ণ। 

ইরানের অনেক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিগতভাবে পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। উদাহরণ হিসেবে শাহাব-৩ এবং এমাদ ক্ষেপণাস্ত্রের সম্মুখ অংশ (নোজ সেকশন) যথেষ্ট নির্ভুলভাবে বানানো, যাতে আকাশে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পারমাণবিক আক্রমণ চালানো সম্ভব। তবে সরাসরি কোনো রাসায়নিক ওয়ারহেড ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জন থেকে এখনও দূরে রয়েছে তেহরান। বিশেষজ্ঞরা এখনও ইরানের হাইপারসনিক ক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান। বর্তমান ক্ষেপণাস্ত্রগুলোতে উন্নত গতিশীলতা বা এড়িয়ে চলার ক্ষমতা যথেষ্ট নয়। এই সংঘাতে রাসায়নিক হামলার আশঙ্কাও তুলনামূলকভাবে কম। 

ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্রের ধরন, রেঞ্জ ও ওয়ারহেড ক্ষমতা

ইসরায়েল মূলত জেরিকো-১ জেরিকো-২ জেরিকো-৩ নামে পরিচিত আন্তঃমহাদেশীয় এবং মধ্যম-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র -আইআরবিএম ও আইসিবিএম- তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ করে।

এসব ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে জেরিকো-১ এর রেঞ্জ প্রায় ৫০০ কিমি এবং প্রায় ৪৫০ কেজি ওয়ারহেড বহন করতে পারে। জেরিকো-২ প্রায় ১,৫০০–৩,৫০০ কিমি দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে এবং সর্বোচ্চ ১,০০০ কেজি ওয়ারহেড বহন করতে পারে। জেরিকো-৩ প্রায় ৪,৮০০–৬,৫০০ কিমি দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। কিছু সূত্রে এটি ৭,৮০০ কিমি দূরত্বে আঘাত হানতে পারে। এবং প্রায় ৭৫০–১,০০০ কেজি ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম।

জেরিকো-৩ কে ইসরায়েলের ‘স্ট্র্যাটেজিক নিউক্লিয়ার ডেটারেন্ট’ হিসেবে ধরা হয়। সাধারণত এদের ওয়ারহেড পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য। যদিও তেলআবিবের সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এমন বিধ্বংসী অস্ত্র থাকার বিষয়টি স্বীকার করেনি। তবে বিভিন্ন গ্লোবাল সিকিউরিটিবিষয়ক প্রতিবেদনের মতে, এসব দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এক বা একাধিক পারমাণবিক বোমা বহন করতে পারে, যাদের বিধ্বংসী ক্ষমতা প্রায় ২০০–৪০০ কিলোটন।

ইসরায়েলের নিজস্ব স্বল্প পাল্লার গাইডেড রকেট ও ভূমি-থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে (যেমন লরা— লং রেঞ্জ আর্টিলার রকেট, যাদের রেঞ্জ প্রায় ৪০০–৫০০ কিমি। এগুলো প্রথাগত ওয়ারহেড (২০০–৪০০ কেজি) বহন করতে সক্ষম। এ ছাড়া ডেলিলাহ ক্রুজ মিসাইল প্রায় ২৫০ কিমি রেঞ্জ অতিক্রম করতে পারে এবং হালকা ওয়ারহেড বহন করতে পারে। ইসরায়েলের দাবি তারা তাদের (পারমাণবিক) ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণাত্মকভাবে ব্যবহার করবে না। এদের মূল উদ্দেশ্য ‘নিউক্লিয়ার সেকেন্ড স্ট্রাইক ক্যাপাবিলিটি’ অর্থাৎ যদি শত্রু পারমাণবিক আক্রমণ করে, তাহলে প্রতিশোধমূলক পারমাণবিক হামলার জন্য প্রস্তুত থাকা।

ইসরায়েলি বিমান ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক তালের ইনবার বলেন, খোর্রমশাহর ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরণ ক্ষমতা ইরানের আগেগার ব্যবহৃত মাঝারি রেঞ্জের ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। অত্যন্ত অস্বাভাবিক হলেও, তাত্ত্বিকভাবে কোনো বড় পরিবর্তন ছাড়াই ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক বোমা বহন করতে সক্ষম হতে পারে। ইরানের বিস্তৃত কৌশলগত লক্ষ্যই তাকে দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে, যার মধ্যে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র বা আইসিবিএম রয়েছে। আমরা এখনও বিশ্বাস করি, ইরান যদি কখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করে, তাহলে তা নিক্ষেপের জন্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রই ব্যবহার করবে।

এদিকে এখন পর্যন্ত ইরানের হামলায় কমপক্ষে ২৪ জন ইসরায়েলি নিহত এবং ৮০৪ জন আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে আটজনের অবস্থা গুরুতর বলে নেতানিয়াহুর অফিস জানিয়েছে।

এ ছাড়া ইরানি গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় ইরানে ৫৮৫ জন নিহত এবং ১,৩০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।

আরটিভি/একে

Copied from: https://rtvonline.com/